নবম-দশম শ্রেণির কোনো ছাত্রকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় মহাকর্ষ বল কী? সে উত্তর দিবে, মহাকাশের মধ্যে দুটি বস্তুর মধ্যকার আকর্ষণ বলই হলো মহাকর্ষ বল। যদি জিজ্ঞেস করি অভিকর্ষ বল কী? তাহলে সে বলবে যেকোনো বস্তুর সাথে পৃথিবীর আকর্ষণ বল। কিন্তু আসলে এই সংজ্ঞা দুটি পুরোপুরি সঠিক নয়। ছাত্রটি ভুল উত্তর দেয় নি। সে যেটি তার বইয়ে পড়েছে সেটি বলেছে। বইয়েও ভুল বলে নি। কারণ নিউটনের তত্ত্ব না পড়ে, বেসিক জ্ঞান না নিয়ে আপনি এক লাফে কোয়ান্টাম তত্ত্ব পড়তে বসে যেতে পারেন না। এই মহাকর্ষ নিয়ে আপাতত দুইটি তত্ত্ব আছে। একটি নিউটনের, যেটির সংজ্ঞা একটু আগে বললাম। আরেকটি আইনস্টাইন এর, যেটি সম্পর্কে একটু পর বলতে যাচ্ছি। এই আইনস্টাইন এর তত্ত্ব আসার পর নিউটনের এটিকে পুরোপুরি সঠিক মানা যায় না। তো কী এই আইনস্টাইন এর তত্ত্ব যার জন্য নিউটনের তত্ত্ব প্রশ্নবিদ্ধ? এই বিষয়ে জেনে নিই।
প্রথমে একটি তথ্য দেই। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো পৌছাতে মোট সময় লাগে প্রায় ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড। ধরো যদি হঠাৎ সূর্য উধাও হয়ে যায় তাহলে আমরা সেটি বুঝবো এই ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড পর। কারণ যখন সূর্য উধাও হয়েছে তখন শেষ মূহুর্তে যে আলো দিয়েছে সেটি আসতে আট মিনিটের বেশী লাগবে মানে এই আট মিনিট আলো থাকবে পৃথিবীতে সূর্য উধাও হওয়ার পরও! কিন্তু নিউটনের তত্ত্বানুসারে পৃথিবীর উপর সাথে সাথে ক্রিয়া করার কথা। কিন্তু আইনস্টাইন তার স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটিতে বলছেন যে, এই মহাবিশ্বে আলোর বেগই সর্বোচ্চ বেগ অর্থাৎ কোনো কিছুর বেগই আলোর বেগকে অতিক্রম করতে পারবে না। এখানেই হলো সমস্যা। যদি কেউ আলোর বেগ অতিক্রম করতে পারে না তাহলে মহাকর্ষ বল কীভাবে সাথে সাথে ক্রিয়া করে? যেখানে আলো আসতে লাগে আট মিনিটের বেশী লাগে সেখানে মহাকর্ষ সাথে সাথে কীভাবে পৌঁছে যায়? তার মানে তো মহাকর্ষের গতি আলোর চেয়ে বেশী হয়ে গেল না? কিন্তু আইস্টাইন বলেছেন আলোর গতি সর্বোচ্চ!
এই প্রশ্নের উত্তর দেয় আইনস্টাইন এর জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি। আমরা আগে মহাবিশ্বকে তিন মাত্রার ধরতাম। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা। কিন্তু আইনস্টাইন বলেছেন এটি চারমাত্রার। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা ও সময়। আর এই চারমাত্রাকে একসাথে বলে স্থানকাল বা Space time. সোজা বাংলায় হলো যে চতুর্মাত্রিক এই মহাবিশ্বের প্রতিটা অংশই হলো স্থানকাল বা Space time. যখন মহাকাশে কোনো বস্তু রাখবো তখন সেটি তার চারপাশের এই স্থানকালকে বাঁকিয়ে ফেলবে। এই বস্তুটি স্থানকালের যে ধরণের বক্রতা তৈরী করেছে তাকেই বলে স্থানকালের বক্রতা! সহজভাবে বুঝার জন্য একটি উদাহরণ দেই।
আপনি একটা টানটান করা চাদরে যদি ভারী কোনো বস্তু রাখেন, তাহলে যেভাবে বস্তুটি চাদরটিকে বাকিয়ে দেয় এটিও অনেকটা এরকম। বস্তুটি যতো ভারী হবে, চাদর ততই বাকবে। তেমনি মহাকাশে কোনো বস্তুর ভর যত বেশি হবে, সেখানকার স্পেস টাইম ততই বাকা হবে। কোনো বস্তুকে মহাকাশে স্থাপন করলে সে তার চারপাশের সব স্থানকে বাঁকিয়ে ফেলে এমনকি সময়ও। আইনস্টাইন এর মতে কোনো বস্তুর উপর স্থানকালের বক্রতার এই প্রভাবই হলো মহাকর্ষ। এটি কোনো বল নয়। এটি সময়কে ধীর করে দিতেও সক্ষম।
এখন যদি কোনো বড় শক্তিশালী বস্তু মহাকাশে থাকে তাহলে এটি তার চারপাশে এমন বক্রতা তৈরি করে যে আলোও বাঁকা হয়ে যায়। সাধারণত আলো সরলপথে চলে। এটি অলরেডি প্রমাণও হয়ে গেছে যে আলো বাঁকাও হয়। আলোর এই বাকা পথে যাওয়াকে গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং বলে। অন্য নক্ষত্র থেকে সূর্যের পাশ দিয়ে আসার সময় আলো কিছুটা বেঁকে গিয়েছিল বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে দেখেছেন। এখন যদি অনেক অনেক শক্তিশালী ভর বিশিষ্ট কোনো বস্তু মহাকাশে থাকে তাহলে সে তার চারপাশের স্থানকে এতটা বক্র করে দেয় যে আলোও বের হয়ে আসতে পারে না! এটি হয় ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে। ব্ল্যাকহোল থেকে আলোও বের হয়ে আসতে পারে না। একটু আগে বলেছি সূর্য হালকা বাঁকা করে আলোকে। যেখানে সূর্যের মতো এত ভারী বস্তু হালকা বাঁকা করে সেখানে এটি ডিরেক্ট নিজের মধ্যে নিয়ে নেয়। তার মানে ভাবেন এটি কত ভারী হবে! আরেকটু আইডিয়া দেই ব্ল্যাকহোলের ভর সম্পর্কে। সবচেয়ে ছোট ব্ল্যাকহোল একটি পরমাণুর মতো, কিন্তু সেটির ভর একটি পাহাড়ের সমান! ভাবেন তো একটু। একটি পরমাণুর ভর পাহাড়ের ভরের সমান!
আরেকটি উদাহরণ দেই। যদি পৃথিবীর যে ভর আছে সেটি না কমিয়ে, পৃথিবীকে ছোট করতে করতে একটি মার্বেলের মতো বানানো যায় তাহলে পৃথিবী একটি ব্ল্যাকহোল হয়ে যাবে! তখন পৃথিবী থেকে আলো বের হয়ে যেতে পারবে না। ভাবেন তো। এই পৃথিবীতে কতকিছু আছে। আপনি আছেন, আমি আছি, হাতি, ঘোড়া, পাহাড়, সমুদ্র কতকিছু আছে। সবার একত্রে ভর কত হবে বুঝতে পারছেন? আর এই পৃথিবী বানাতে হবে একটি মার্বেলের আকারের সমান। মার্বেল তো চিনি যাকে কিনা হাতের মুঠোয় রাখা যায়। এই পৃথিবীকে মার্বেলের মতো বানানো লাগবে কিন্তু ভর কমানো যাবে না। মানে এই মার্বেলের ভর হতে হবে পুরো পৃথিবীর সমান। তবেই পৃথিবী ব্ল্যাকহোল হবে। তবে এটি অনেকটা অসম্ভব। কারণ মূলত নক্ষত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। পৃথিবী একটি গ্রহ। তাই এটি হবে না বললেই চলে। আমি শুধু তাত্ত্বিক বিষয়টা বললাম।
আবার মেইন বিষয়ে চলে আসি। নিউটনের তত্ত্ব ও আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি থেকে অনেকদূর চলে এসেছি।
এবার বলি কেন পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরে।
এর কারণ হচ্ছে সেই স্থানকালের বক্রতা। সূর্যের স্থানকালের বক্রতার জন্য সৌরজগতের স্পেস বেকে গেছে, সেজন্য পৃথিবীর গতিও বাকা হয়েছে। জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি অনুযায়ী, মহাকর্ষ কোনো আকর্ষণবল নয় তাই পৃথিবীর উপর কোনো বাহ্যিক বল কাজ করছে না। সেই অতীতে যে পরিমাণ বল পৃথিবীকে সূর্যের স্থানকালের বক্রতার ভেতরে নিয়ে এসেছে, সেই বলই এখন পৃথিবীকে সূর্যের চারপাশে ঘুরতে বাধ্য করছে কারণ এখনো সেই বলটি কার্যকর রয়েছে যেহেতু বলটিকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য সেখানে কোনো বাহ্যিক বল নেই। বাহ্যিক বল ছাড়া স্থির বস্তু স্থির আর গতিশীল বস্তু গতিশীল থাকে। এইরকম একটা সূত্র আছে না? আরেকটি ভুল আমরা সচরাচর করি! সূর্যের আকর্ষণের কারণে পৃথিবী তার চারপাশে ঘোরে, এমনটা বলি। আসলে এটিও ঠিক নয়। সত্য হলো সূর্যের স্থানকালের প্রভাবের কারণেই পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরতে বাধ্য। এখনে মহাকর্ষ নামে কোনো বল নাই। ঐ যে স্থানকালের প্রভাবে পৃথিবীকে ঘুরতে বাধ্য করছে এটাই হলো মহাকর্ষ! দুটি বস্তুর মধ্যে যার ভর বেশী হবে তার স্থানকালের বক্রতার প্রভাব বেশী হবে। তার চারপাশে ঘুরবে। যেমন এখানে সূর্যের ভর বেশী তাই পৃথিবী ঘুরছে।
আশা করি আসলে মহাকর্ষ কী তা বুঝাতে পেরেছি কিছুটা। এটি মূলত আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি ব্যাখ্যা করে। আইনস্টাইনের এই থিওরি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হয়তো পেয়েছেন। ভাববেন না আবার এই থিওরি পুরো বুঝে গিয়েছেন। থিওরি অফ রিলেটিভিটি বিজ্ঞানের ইতিহাসের দ্বিতীয় দুর্বোধ্য থিওরি বলা হয়। প্রথম ধরা হয় কোয়ান্টাম তত্ত্বকে! আমি নিজেও বুঝি না পুরো তত্ত্বটা। যা জানি তা বললাম। কেমন লাগলো জানাবেন। একটি মজার তথ্য দেই। এই মাথা নষ্ট করা থিওরিটি আইনস্টাইন দিয়েছিলেন মাত্র ২৫ বছর বয়সে!
🖋 লিখা: হুজায়ফা আহমদ